বন্ধুও, আবার শয্যাসঙ্গীও। নেই প্রেম, নেই আনুগত্য। চাহিদা একই। মেটাচ্ছেন একে অপরে। তাঁদের একে অপরের মন জয় করার বাধ্যবাধকতা নেই। নিজেকে লুকোনোরও প্রয়োজন নেই। তাঁরা একে অপরের স্পর্শে খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। এখানেই ইতি। পরিণতি? ওই বন্ধুত্বই। প্রেমের সম্পর্ক বা দাম্পত্য নয়। এমন সম্পর্কের নাম? বন্ধুত্ব। তবে যুক্ত হচ্ছে নতুন শব্দ। সুবিধা বা লাভ। কিন্তু বন্ধুত্বে আবার লাভ-লোকসান হয় নাকি? যা হয়, তা হল যৌনসুখ। এমনই বন্ধুত্বের ইংরেজি অভিধা ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’। কিন্তু সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে অধিকাংশ সময়ে বন্ধুত্বে ইতি টানা হয় না। মিলা কুনিস এবং জাস্টিন টিম্বারলেকের ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’ ছবির মতো শেষমেশ প্রেম আসে, আনুগত্য আসে। এবং বন্ধুত্ব রূপ নেয় প্রেমিক-প্রেমিকায়। কিন্তু বাস্তব জীবনে সব সময়ে এমন সম্পর্কের শেষে প্রেম না-ও আসতে পারে। তাঁরা কেবল বন্ধুই থাকতে পারেন। একে অপরের থেকে এই বিশেষ সুবিধা নিয়ে বন্ধু হয়ে থেকে যেতে পারেন। পশ্চিমী দেশে এখন এই ধরনের বন্ধুত্ব তথা ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’-এর বিষয়ে প্রায় সবাই পরিচিত। ভারতীয় উপমহাদেশে এই শব্দবন্ধটি এখনও ততখানি পরিচিতি পায়নি।
অভিনেতা-পরিচালক রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’-এর অভিধার সঙ্গে নতুন ভাবে পরিচিত। তিনিও বন্ধুত্বের পাশে ‘বেনেফিট’ শব্দটিকে এক ভাবে দেখতে অভ্যস্ত। লাভ, ফায়দা ইত্যাদিই তাঁর মনে আসে। ভারতবর্ষের নিরিখে এ শব্দ বা এই অনুশীলন যে এখনও খানিক দূরের, তা রাহুলের বিশ্বাস। আর তাই বললেন, ‘‘এই তিনটি শব্দ পাশাপাশি বসালে যা বোঝায়, তা তো আমি জানি, যে বন্ধুত্বে দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। শারীরিক সম্পর্কই যে কেবল এখানে বোঝানো হয়, তা জানতামই না। সেই ধরনের সম্পর্কে আমাদের প্রজন্মের কত জন জড়িয়েছেন, সন্দেহ রয়েছে। তবে আমার সন্তান সহজরা সহজেই এই অনুশীলনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। বন্ধুত্ব ও শারীরিক সম্পর্ক ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেলে কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে আমার অত ধারণা নেই। কিন্তু আমরা বন্ধুত্বের মাঝে (যদি তা প্রকৃত হয়) কোনও প্রকার লাভ-লোকসানই খুঁজি না। তা সে কাজ দেওয়া হোক, বা কাজ নেওয়া, যৌন সম্পর্ক হোক বা অন্য কিছু।’’
অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র সুর মেলালেন রাহুলের সঙ্গে। ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’ শব্দবন্ধটিকে তিনিও অন্য ভাবেই দেখেন। অভিনেত্রী বলছেন, ‘‘বন্ধুত্ব, যেখানে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, তাই-ই তো ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’। এক তথাকথিত বন্ধুর শয্যাসঙ্গিনী হয়ে নিজের কাজের জন্য সুবিধা নেওয়ার ঘটনা তো আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আকছার ঘটে। সেটাকে আমি বন্ধুত্ব বলি না। বরং এই অভিধার আসল অর্থ আমার কাছে এটিই। নয়তো প্রকৃত বন্ধুর সঙ্গে যৌনতার কথা কল্পনা করতে আমার অসুবিধা হয়। তাতে আর বন্ধুত্ব কোথায় থাকে? যেমন আমার কলেজের এক পুরুষ বন্ধু, কর্মসূত্রে বাইরে থাকে। যখনই আসে, আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। আমরা কফি খেতে যাই। কিন্তু স্ত্রীকে লুকিয়ে আসে না। কারণ তার মনের মধ্যে বা আমারও কোথাও চাপা যৌন আগ্রহ নেই। বন্ধুর সঙ্গে তাই আমি শারীরিক ভাবে লিপ্ত হতে পারব না। তবে হ্যাঁ, কিন্তু যদি কেউ হন, তাতে আমার কোনও সমস্যা নেই।’’
কিন্তু তার পরেও দেশেবিদেশে এমন সম্পর্ক তৈরি হতে দেখা যায়। যেখানে বন্ধুত্ব থাকে, পাশাপাশি শারীরিক সম্পর্কও। তা কিন্তু ‘ক্যাজ়ুয়াল সম্পর্ক’ বা ‘হুক আপ’ নয়। কারণ সেগুলিতে যৌনতাই প্রধান চরিত্রে থাকে, আর ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’-এ মুখ্য চরিত্রে বন্ধুত্ব। তা হলে কেন বন্ধুদের কাছেই এমন সুখ সন্ধানে যান কেউ কেউ? মনোবিদ ঝুমা বসাকের মতে, মানুষ আসলে আরামপ্রিয়। তাই যে দুই বন্ধু একে অপরের খুঁটিনাটি জানেন, একে অপরের খারাপ-ভাল সব জানেন, যাঁরা একে অপরের ভাল-মন্দের বিচার করেন না, তাঁরাই বন্ধুত্বের সম্পর্কটিকে আর একটু প্রসারিত করতে চান। ঝুমার কথায়, ‘‘যখন বন্ধুত্ব হচ্ছে, সেই মুহূর্তে সেই সম্পর্কের মধ্যে অন্য কিছু নেই। কিন্তু যে মুহূর্তে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাচ্ছে, সেটি কিন্তু আর এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। তা সে যতই এই সম্পর্কের অভিধায় ‘ফ্রেন্ডশিপ’ শব্দটি থাকুক না কেন। তখন এই বন্ধুত্বের মাঝে ‘বেনেফিটস’ বা সুবিধা প্রাধান্য পাচ্ছে। কিন্তু এখানে কোনও বন্ধন বা প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না, বাঁধন নেই— এমনটাই ভেবে এগোন তাঁরা। কিন্তু মনের সুপ্ত বাসনার দিকে সেই মুহূর্তে তাকাতে চান না কেউ। পরবর্তী কালে সেখান থেকেই নানাবিধ সমস্যা শুরু হয়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, দু’জন বন্ধু কেন এই সুখ খুঁজতে একে অন্যের দ্বারস্থ হচ্ছেন?’’ ঝুমার মতে, যে সম্পর্কে রয়েছেন, সেই সম্পর্ক থেকেই তাঁদের আরও আরাম চাই, আরও আদর চাই। দু’টি জিনিসে মানুষের চাহিদা কখনও মেটে না, আদর-ভালবাসা এবং অর্থ। আসলে তাঁরা হয়তো ভাবছেন, যে সম্পর্কটি আগে থেকেই রয়েছে, তাকেই আর একটু এগিয়ে নিয়ে গেলে বন্ধুত্বের রসটা থেকে যাবে, আরও দৃঢ় হবে। অথবা বন্ধুর সঙ্গে যে আরামদায়ক সম্পর্ক আগে থেকেই রয়েছে, তা হয়তো এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক হতে পারে। একে অপরকে বুঝতে হয়তো আরও সুবিধা হবে। কিন্তু সব সময়ে এই আশা পূরণ হয় না। সম্পর্কের জটিলতা এখানে চলে আসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে।
তবে ভারতের নতুন প্রজন্মের কাছে এই ধরনের সম্পর্ক আজগুবি নয়। সাহিত্য, চলচ্চিত্রেও নানা ধরনের প্রেম ও বন্ধুত্বের কাহিনি জায়গা পাচ্ছে। তাই এই বিষয় নিয়ে আরও খোলামেলা আলোচনা হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন অভিনেত্রী শোলাঙ্কি রায়। বলছেন, ‘‘একটি মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে যাই কেন আমরা? কোনও এক প্রকার সুখ পেতেই তো! কোনও এক প্রকার বেনেফিটই তো সেটা। আমার মতের সঙ্গে তাঁর মতের মিল, তাতে আমার মানসিক সুখ, আমার সুখ-দুঃখে তাঁকে পাশে পাই, এগুলি কি পাওয়া নয়? বেনেফিটকে তাই কেবল বাঁকা চোখে দেখলেই হবে না। তবে একই ভাবে এই পাওয়াগুলির মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও থাকতে পারে। তবে হ্যাঁ, মানুষের সম্পর্ক বড় জটিল। দুই বন্ধুর ক্ষণিকের বা কয়েক দিন বা মাসের অথবা বছরের এই সম্পর্ক বন্ধুত্বে অনায়াসে কোপ ফেলতে পারে।’’ শোলাঙ্কি তাঁর নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দেখেছেন। অত্যন্ত সুন্দর বন্ধুত্ব ছিল এক সময়ে। তার পর তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, আরও একটু ঘনিষ্ঠ হতে চান তাঁরা। আর বছরকয়েক বাদে সেই দুই বন্ধু আর একে অপরের মুখ দেখেন না। দু’টি মানুষের মন একই সময়ে একই জিনিস চায় না। ফলে কারও মনে প্রেমের বা সম্পর্কের আশা তৈরি হলে অন্য জনেরও যে হবে, তা তো নয়। শেষমেশ বন্ধুত্বই আবছা হয়ে যায়। মানুষের মৌলিক ভাবে অধিকারবোধের অধিকারী। শোলাঙ্কি মনে করেন, আমরা যে ভাবে জামাকাপড়, গয়না, বিছানা, চাদর, টিফিন, সবকিছু নিজেদের মালিকানা প্রকাশ করতে চাই, তাতে মানুষকে নিয়ে তো অধিকারবোধ আসবেই। সমস্ত সমস্যার সূত্রপাত সেখানেই। তাই যে ভাবে প্রেমের সম্পর্কেও বিবাদ দেখা দেয়, এ ক্ষেত্রেও দেখা দিতে পারে।
তা হলে ভেঙে যাবে বন্ধুত্ব? সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য কী করা যেতে পারে? তাঁরা কী ভাবে নিজেদের বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রাখবেন? কী ভাবে বন্ধুর জীবনে নতুন মানুষ এলে হিংসেতে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবেন না? মনোবিদ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, যাঁরা বন্ধুত্বের সম্পর্ক এবং যৌন সম্পর্কের দুই বৃত্তকে সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা রাখতে পারেন, তাঁদের পক্ষে এই ধরনের বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হল, ভারতের মতো দেশের বাসিন্দারা এখনও ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান দিতে জানেন না। ফলে ব্যক্তিগত পরিসরের ওই রেখা যদি বার বার লঙ্ঘিত হয়, তা হলে এই সম্পর্কটিকে বজায় রাখা সহজ হবে না। মনোবিদ বলছেন, ‘‘যে কোনও সম্পর্কেই আঁকড়ে ধরার প্রবণতা দেখা দেয় আমাদের মধ্যে। আমাদের উপমহাদেশে দু’টি মানুষের সম্পর্কের মধ্যে অনেকটা বেশি পরিমাণে থাকে মানসিক বন্ধন। তাই শারীরিক সম্পর্ককে খুব দ্রুত মনের কাছে নিয়ে আসতে চাই আমরা। কিন্তু যদি দেওয়া-নেওয়ার এই বন্ধুত্বে বন্ধুত্বটাই আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তা হলে আগে থেকে সমস্ত বিষয় নিয়ে খোলাখুলি কথা বলে নেওয়া উচিত।’’ সুর মেলালেন মনোবিদ শ্রাবস্তী মজুমদার। তাঁর মতে, দুই বন্ধু তখনই এতটা কাছে আসতে পারেন, যখন তাঁরা নিরাপদ বোধ করেন। অচেনা জগতে পা রাখার ভয় নেই সেখানে। ব্যক্তিগত পরিসরের সীমারেখা মিলিয়ে যাওয়ার আশ নেই। প্রেমের সম্পর্কের মতো আনুগত্যের বাঁধাধরা গতে পড়েন না তাঁরা। সে ক্ষেত্রে এতটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর দূরত্ব যেন তৈরি না হয়। তার জন্য আগে থেকে পদক্ষেপ করতে হবে। আর তাই, ‘‘দু’টি বন্ধুর মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা থাকতে হবে। নয়তো প্রত্যাশা তৈরি হতে সময় লাগবে না। তা ছাড়া প্রতি মুহূর্তে দু’জনকে দু’জনের অনুমতি নিয়ে পদক্ষেপ করতে হবে। তবেই বন্ধুত্ব টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নিজেকেও সচেতন থাকতে হবে। দু’টি প্রশ্ন নিজেকে করতে হবে— কেন এই সম্পর্কে যেতে চাইছি, কী চাইছি। উত্তর যেন থাকে নিজের কাছে।’’
তবে এই সমস্ত তত্ত্বকে ভিত্তিহীন দাবি অভিনেত্রী ঋ ওরফে ঋতুপর্ণা সেনের। তিনি মনে করেন, পুরুষ ও নারী কখনও বন্ধু হতেই পারে না। কিন্তু দুই পুরুষ ও দুই নারীর মধ্যেও তো বন্ধুত্ব থেকে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। তা হলে? ঋ বলছেন, ‘‘আমি মনে করি, পুরুষদের সঙ্গে মহিলাদের বন্ধুত্ব খুব কঠিন এক বিষয়। পুরুষদের নিন্দা করছি না, কিন্তু মহিলাদের বোঝার মতো ক্ষমতা বোধ হয় তাঁদের নেই। আর তাই বন্ধুত্ব নয়, কেবল শারীরিক সম্পর্ক হতেই পারে। নিজের জীবন থেকে শিখেছি। ঠিক যে ভাবে আমার প্রাক্তন কিউ (চিত্রপরিচালক) কিন্তু আমার বন্ধু ছিল না। আগে আমাদের প্রেম হয়েছে, তার পর আমরা বন্ধু হয়েছি। কিন্তু সেটির ভিত্তি ছিল প্রেম। তাই ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’-এর গোটা তত্ত্ব, শারীরিক সম্পর্কে থাকা দুই বন্ধু যদি পুরুষ ও নারী হন, তা হলে তাতে কতখানি বন্ধুত্ব আদৌ ছিল বা আছে, আমার তাতেই সন্দেহ।’’ নারী, পুরুষ, বন্ধুত্ব, সব নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন ঋ। নারী-পুরুষের সুবিধাজক এই বন্ধুত্বের ভিতই সেখানে নড়বড়ে। সে ক্ষেত্রে সমলিঙ্গের বন্ধুত্বে এই সম্পর্ক হতে পারে বলে তাঁর মত।
তবে কি দুই বন্ধুর যৌনস্পর্শ তাঁদের বন্ধুত্বকেই ধ্বংস করে দিতে পারে? মনোবিদদের বিশ্বাস, ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়। তবে যদি প্রেম এখানে উদ্দেশ্য না হয়, তা হলে অবশ্যই জলের মতো স্বচ্ছতা প্রয়োজন। তা হলেই বন্ধুতায় আঁচ পড়ার সম্ভাবনা কম।
অভিনেতা-পরিচালক রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’-এর অভিধার সঙ্গে নতুন ভাবে পরিচিত। তিনিও বন্ধুত্বের পাশে ‘বেনেফিট’ শব্দটিকে এক ভাবে দেখতে অভ্যস্ত। লাভ, ফায়দা ইত্যাদিই তাঁর মনে আসে। ভারতবর্ষের নিরিখে এ শব্দ বা এই অনুশীলন যে এখনও খানিক দূরের, তা রাহুলের বিশ্বাস। আর তাই বললেন, ‘‘এই তিনটি শব্দ পাশাপাশি বসালে যা বোঝায়, তা তো আমি জানি, যে বন্ধুত্বে দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। শারীরিক সম্পর্কই যে কেবল এখানে বোঝানো হয়, তা জানতামই না। সেই ধরনের সম্পর্কে আমাদের প্রজন্মের কত জন জড়িয়েছেন, সন্দেহ রয়েছে। তবে আমার সন্তান সহজরা সহজেই এই অনুশীলনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। বন্ধুত্ব ও শারীরিক সম্পর্ক ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেলে কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে আমার অত ধারণা নেই। কিন্তু আমরা বন্ধুত্বের মাঝে (যদি তা প্রকৃত হয়) কোনও প্রকার লাভ-লোকসানই খুঁজি না। তা সে কাজ দেওয়া হোক, বা কাজ নেওয়া, যৌন সম্পর্ক হোক বা অন্য কিছু।’’
অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র সুর মেলালেন রাহুলের সঙ্গে। ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’ শব্দবন্ধটিকে তিনিও অন্য ভাবেই দেখেন। অভিনেত্রী বলছেন, ‘‘বন্ধুত্ব, যেখানে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, তাই-ই তো ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’। এক তথাকথিত বন্ধুর শয্যাসঙ্গিনী হয়ে নিজের কাজের জন্য সুবিধা নেওয়ার ঘটনা তো আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আকছার ঘটে। সেটাকে আমি বন্ধুত্ব বলি না। বরং এই অভিধার আসল অর্থ আমার কাছে এটিই। নয়তো প্রকৃত বন্ধুর সঙ্গে যৌনতার কথা কল্পনা করতে আমার অসুবিধা হয়। তাতে আর বন্ধুত্ব কোথায় থাকে? যেমন আমার কলেজের এক পুরুষ বন্ধু, কর্মসূত্রে বাইরে থাকে। যখনই আসে, আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। আমরা কফি খেতে যাই। কিন্তু স্ত্রীকে লুকিয়ে আসে না। কারণ তার মনের মধ্যে বা আমারও কোথাও চাপা যৌন আগ্রহ নেই। বন্ধুর সঙ্গে তাই আমি শারীরিক ভাবে লিপ্ত হতে পারব না। তবে হ্যাঁ, কিন্তু যদি কেউ হন, তাতে আমার কোনও সমস্যা নেই।’’
কিন্তু তার পরেও দেশেবিদেশে এমন সম্পর্ক তৈরি হতে দেখা যায়। যেখানে বন্ধুত্ব থাকে, পাশাপাশি শারীরিক সম্পর্কও। তা কিন্তু ‘ক্যাজ়ুয়াল সম্পর্ক’ বা ‘হুক আপ’ নয়। কারণ সেগুলিতে যৌনতাই প্রধান চরিত্রে থাকে, আর ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’-এ মুখ্য চরিত্রে বন্ধুত্ব। তা হলে কেন বন্ধুদের কাছেই এমন সুখ সন্ধানে যান কেউ কেউ? মনোবিদ ঝুমা বসাকের মতে, মানুষ আসলে আরামপ্রিয়। তাই যে দুই বন্ধু একে অপরের খুঁটিনাটি জানেন, একে অপরের খারাপ-ভাল সব জানেন, যাঁরা একে অপরের ভাল-মন্দের বিচার করেন না, তাঁরাই বন্ধুত্বের সম্পর্কটিকে আর একটু প্রসারিত করতে চান। ঝুমার কথায়, ‘‘যখন বন্ধুত্ব হচ্ছে, সেই মুহূর্তে সেই সম্পর্কের মধ্যে অন্য কিছু নেই। কিন্তু যে মুহূর্তে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাচ্ছে, সেটি কিন্তু আর এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। তা সে যতই এই সম্পর্কের অভিধায় ‘ফ্রেন্ডশিপ’ শব্দটি থাকুক না কেন। তখন এই বন্ধুত্বের মাঝে ‘বেনেফিটস’ বা সুবিধা প্রাধান্য পাচ্ছে। কিন্তু এখানে কোনও বন্ধন বা প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না, বাঁধন নেই— এমনটাই ভেবে এগোন তাঁরা। কিন্তু মনের সুপ্ত বাসনার দিকে সেই মুহূর্তে তাকাতে চান না কেউ। পরবর্তী কালে সেখান থেকেই নানাবিধ সমস্যা শুরু হয়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, দু’জন বন্ধু কেন এই সুখ খুঁজতে একে অন্যের দ্বারস্থ হচ্ছেন?’’ ঝুমার মতে, যে সম্পর্কে রয়েছেন, সেই সম্পর্ক থেকেই তাঁদের আরও আরাম চাই, আরও আদর চাই। দু’টি জিনিসে মানুষের চাহিদা কখনও মেটে না, আদর-ভালবাসা এবং অর্থ। আসলে তাঁরা হয়তো ভাবছেন, যে সম্পর্কটি আগে থেকেই রয়েছে, তাকেই আর একটু এগিয়ে নিয়ে গেলে বন্ধুত্বের রসটা থেকে যাবে, আরও দৃঢ় হবে। অথবা বন্ধুর সঙ্গে যে আরামদায়ক সম্পর্ক আগে থেকেই রয়েছে, তা হয়তো এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক হতে পারে। একে অপরকে বুঝতে হয়তো আরও সুবিধা হবে। কিন্তু সব সময়ে এই আশা পূরণ হয় না। সম্পর্কের জটিলতা এখানে চলে আসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে।
তবে ভারতের নতুন প্রজন্মের কাছে এই ধরনের সম্পর্ক আজগুবি নয়। সাহিত্য, চলচ্চিত্রেও নানা ধরনের প্রেম ও বন্ধুত্বের কাহিনি জায়গা পাচ্ছে। তাই এই বিষয় নিয়ে আরও খোলামেলা আলোচনা হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন অভিনেত্রী শোলাঙ্কি রায়। বলছেন, ‘‘একটি মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে যাই কেন আমরা? কোনও এক প্রকার সুখ পেতেই তো! কোনও এক প্রকার বেনেফিটই তো সেটা। আমার মতের সঙ্গে তাঁর মতের মিল, তাতে আমার মানসিক সুখ, আমার সুখ-দুঃখে তাঁকে পাশে পাই, এগুলি কি পাওয়া নয়? বেনেফিটকে তাই কেবল বাঁকা চোখে দেখলেই হবে না। তবে একই ভাবে এই পাওয়াগুলির মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও থাকতে পারে। তবে হ্যাঁ, মানুষের সম্পর্ক বড় জটিল। দুই বন্ধুর ক্ষণিকের বা কয়েক দিন বা মাসের অথবা বছরের এই সম্পর্ক বন্ধুত্বে অনায়াসে কোপ ফেলতে পারে।’’ শোলাঙ্কি তাঁর নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দেখেছেন। অত্যন্ত সুন্দর বন্ধুত্ব ছিল এক সময়ে। তার পর তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, আরও একটু ঘনিষ্ঠ হতে চান তাঁরা। আর বছরকয়েক বাদে সেই দুই বন্ধু আর একে অপরের মুখ দেখেন না। দু’টি মানুষের মন একই সময়ে একই জিনিস চায় না। ফলে কারও মনে প্রেমের বা সম্পর্কের আশা তৈরি হলে অন্য জনেরও যে হবে, তা তো নয়। শেষমেশ বন্ধুত্বই আবছা হয়ে যায়। মানুষের মৌলিক ভাবে অধিকারবোধের অধিকারী। শোলাঙ্কি মনে করেন, আমরা যে ভাবে জামাকাপড়, গয়না, বিছানা, চাদর, টিফিন, সবকিছু নিজেদের মালিকানা প্রকাশ করতে চাই, তাতে মানুষকে নিয়ে তো অধিকারবোধ আসবেই। সমস্ত সমস্যার সূত্রপাত সেখানেই। তাই যে ভাবে প্রেমের সম্পর্কেও বিবাদ দেখা দেয়, এ ক্ষেত্রেও দেখা দিতে পারে।
তা হলে ভেঙে যাবে বন্ধুত্ব? সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য কী করা যেতে পারে? তাঁরা কী ভাবে নিজেদের বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রাখবেন? কী ভাবে বন্ধুর জীবনে নতুন মানুষ এলে হিংসেতে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবেন না? মনোবিদ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, যাঁরা বন্ধুত্বের সম্পর্ক এবং যৌন সম্পর্কের দুই বৃত্তকে সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা রাখতে পারেন, তাঁদের পক্ষে এই ধরনের বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হল, ভারতের মতো দেশের বাসিন্দারা এখনও ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান দিতে জানেন না। ফলে ব্যক্তিগত পরিসরের ওই রেখা যদি বার বার লঙ্ঘিত হয়, তা হলে এই সম্পর্কটিকে বজায় রাখা সহজ হবে না। মনোবিদ বলছেন, ‘‘যে কোনও সম্পর্কেই আঁকড়ে ধরার প্রবণতা দেখা দেয় আমাদের মধ্যে। আমাদের উপমহাদেশে দু’টি মানুষের সম্পর্কের মধ্যে অনেকটা বেশি পরিমাণে থাকে মানসিক বন্ধন। তাই শারীরিক সম্পর্ককে খুব দ্রুত মনের কাছে নিয়ে আসতে চাই আমরা। কিন্তু যদি দেওয়া-নেওয়ার এই বন্ধুত্বে বন্ধুত্বটাই আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তা হলে আগে থেকে সমস্ত বিষয় নিয়ে খোলাখুলি কথা বলে নেওয়া উচিত।’’ সুর মেলালেন মনোবিদ শ্রাবস্তী মজুমদার। তাঁর মতে, দুই বন্ধু তখনই এতটা কাছে আসতে পারেন, যখন তাঁরা নিরাপদ বোধ করেন। অচেনা জগতে পা রাখার ভয় নেই সেখানে। ব্যক্তিগত পরিসরের সীমারেখা মিলিয়ে যাওয়ার আশ নেই। প্রেমের সম্পর্কের মতো আনুগত্যের বাঁধাধরা গতে পড়েন না তাঁরা। সে ক্ষেত্রে এতটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর দূরত্ব যেন তৈরি না হয়। তার জন্য আগে থেকে পদক্ষেপ করতে হবে। আর তাই, ‘‘দু’টি বন্ধুর মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা থাকতে হবে। নয়তো প্রত্যাশা তৈরি হতে সময় লাগবে না। তা ছাড়া প্রতি মুহূর্তে দু’জনকে দু’জনের অনুমতি নিয়ে পদক্ষেপ করতে হবে। তবেই বন্ধুত্ব টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নিজেকেও সচেতন থাকতে হবে। দু’টি প্রশ্ন নিজেকে করতে হবে— কেন এই সম্পর্কে যেতে চাইছি, কী চাইছি। উত্তর যেন থাকে নিজের কাছে।’’
তবে এই সমস্ত তত্ত্বকে ভিত্তিহীন দাবি অভিনেত্রী ঋ ওরফে ঋতুপর্ণা সেনের। তিনি মনে করেন, পুরুষ ও নারী কখনও বন্ধু হতেই পারে না। কিন্তু দুই পুরুষ ও দুই নারীর মধ্যেও তো বন্ধুত্ব থেকে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। তা হলে? ঋ বলছেন, ‘‘আমি মনে করি, পুরুষদের সঙ্গে মহিলাদের বন্ধুত্ব খুব কঠিন এক বিষয়। পুরুষদের নিন্দা করছি না, কিন্তু মহিলাদের বোঝার মতো ক্ষমতা বোধ হয় তাঁদের নেই। আর তাই বন্ধুত্ব নয়, কেবল শারীরিক সম্পর্ক হতেই পারে। নিজের জীবন থেকে শিখেছি। ঠিক যে ভাবে আমার প্রাক্তন কিউ (চিত্রপরিচালক) কিন্তু আমার বন্ধু ছিল না। আগে আমাদের প্রেম হয়েছে, তার পর আমরা বন্ধু হয়েছি। কিন্তু সেটির ভিত্তি ছিল প্রেম। তাই ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিটস’-এর গোটা তত্ত্ব, শারীরিক সম্পর্কে থাকা দুই বন্ধু যদি পুরুষ ও নারী হন, তা হলে তাতে কতখানি বন্ধুত্ব আদৌ ছিল বা আছে, আমার তাতেই সন্দেহ।’’ নারী, পুরুষ, বন্ধুত্ব, সব নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন ঋ। নারী-পুরুষের সুবিধাজক এই বন্ধুত্বের ভিতই সেখানে নড়বড়ে। সে ক্ষেত্রে সমলিঙ্গের বন্ধুত্বে এই সম্পর্ক হতে পারে বলে তাঁর মত।
তবে কি দুই বন্ধুর যৌনস্পর্শ তাঁদের বন্ধুত্বকেই ধ্বংস করে দিতে পারে? মনোবিদদের বিশ্বাস, ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়। তবে যদি প্রেম এখানে উদ্দেশ্য না হয়, তা হলে অবশ্যই জলের মতো স্বচ্ছতা প্রয়োজন। তা হলেই বন্ধুতায় আঁচ পড়ার সম্ভাবনা কম।